-->

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক চন্দ্রগুপ্ত

 

ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকের সার্থকতা

ঐতিহাসিক নাটক হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটকের সার্থকতা

মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী নাটক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারখানি ঐতিহাসিক নাটক, দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটক রচনার বহু পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল। কৃষ্ণকুমারী নিছক একখানি ট্র্যাজেডি, সেখানে মেবারের রাণার দুর্বলতার পরিচয়ই পাওয়া যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ঐতিহাসিক নাটকগুলো প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে রোমান্টিক নাটক। দেশপ্রীতিই যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দৃষ্টি ইতিহাসের দিকে ফিরিয়েছিল তা তিনি স্বীকার করেছেন তাঁর জীবনস্মৃতিতে। তিনি লিখেছেন, “হিন্দুমেলার পর হইতে কেবলই আমার মনে হইতকি উপায়ে দেশের প্রতি লোকের অনুরাগ ও স্বদেশ প্রীতি উদ্বোধিত হইতে পারে। শেষে স্থির করিলাম, নাটকে ঐতিহাসিক বীরত্বগাথা ও ভারতের গৌরব কাহিনী কীর্তন করিলে হয়ত কতকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইতে পারে। তাঁর কয়েকটি নাটকে হিন্দু মুসলমানের বিরোধী রূপে দেখা দিয়ে কিছুটা সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠে দেশপ্রেমকে আঘাতই করেছে। তাই তাঁর ঐতিহাসিক নাটক গণচেতনাকে ঐক্যবদ্ধ বঙ্গদেশের দিকেই দৃষ্টি দিয়েছিলেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি জানা ইতিহাসকে যথাযথরূপে স্থান দিয়েছেন। অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, “স্বদেশী আন্দোলনের সমসাময়িক নাট্যগুলির মধ্যে তাঁহার যে ঐতিহাসিক তথ্যনিষ্ঠা প্রকাশ পাইয়াছে তাহা প্রকৃতই বিস্ময়কর। গিরিশচন্দ্রের 'সিরাজদৌল্লাবাঙালীর মনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

এ সময়েই বঙ্গদেশে রাজনীতিক আন্দোলন আরম্ভ হয়। তখনও পূর্ণ স্বাধীনতার কথা ততটা প্রাধান্য পায়নি। আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করার জন্য, দেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার আস্বাদ পাবার আগ্রহ জাগাবার উদ্দেশ্যে নেতারা তখন ম্যাটসিনি-গ্যারিবল্ভির কথা শোনাচ্ছেন। সেই সব বক্তৃতার প্রতিধ্বনিও শোনা গেছে এই নাটকে। সিরাজদৌল্লা হিন্দ-মুসলমানের ঐক্য স্থাপনেও সাহায্য করেছে। মুসলমান যুগের কাহিনী অবলম্বনে নাটক রচনার পরে গিরিশচন্দ্র হিন্দু যুগের কাহিনী অবলম্বনে নাটক রচনা করেন। একে হিন্দু- বৌদ্ধযুগ বলা চলে।

দেশে তখন জাতীয় মনোভাব দেখা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু গিরিশচন্দ্র সেই উত্তেজনাকর মুহূর্তে এক সিরাজদৌল্লাব্যতীত কোন নাটক লেখেননি। কিন্তু গিরিশচন্দ্র অপেক্ষা কিছু পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণ করায় অনেক সুবিধা হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলালের। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন বঙ্গদেশকে উত্তাল করে তুলেছিল তিনি তার ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। গিরিশচন্দ্রও অবশ্য সে-সময়টা পেয়েছিলেন, কিন্তু তখন আর যৌবনের শক্তি ছিল না। বিশেষ তিনি মূলত ছিলেন ভক্তিমার্গের পথিক। তাই একবার জ্বলে উঠেই তিনি স্তিমিত হয়ে পড়েছিলেন। রাণা প্রতাপকে অবলম্বন করে নাটক রচনা করতে গিয়েও তিনি তা সমাপ্ত করতে পারেননি। ধর্মকেন্দ্রিক 'অশোকনাটকটি অবশ্যই তিনি লিখেছিলেন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে অধিকতর উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল। রাজস্থানের শৌর্য-বীর্যই ছিল তাঁর উপজীব্য। ১৯০৩ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত পর পর কয়েকটি জাতীয় ভাব উদ্দীপক নাটক রচনা করেন তিনি। জাতীয় জীবনে এক ঐতিহাসিক মুহুর্তে রচিত হয় তারাবাঈ (১৯০৩), রাণা প্রতাপসিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৬), মেবার-পতন (১৯০৮) এবং সাজাহান (১৯০৯)।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ভারত-আক্রমণকারী মুসলমান শক্তির বিরোধীরূপে হিন্দুর শক্তিকে দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি মধ্যযুগের প্রকৃত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি রেখে সমকালীন ভারতের কথা চিন্তা করেননি। তিনি তথ্যনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের পক্ষে তা করা সম্ভব হয়নি। তিনি সমকালীন প্রয়োজনের দিকেই দৃষ্টি রেখে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলো রচনা করতে বসেছিলেন। ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গচ্ছেদ করা হবে এই ছিল বড়লাটের ঘোষণা। লক্ষ্যণীয় যে, সেই সালেই রচিত হয় রাজস্থানের কিংবদন্তী বীরপুরুষ রাণা প্রতাপকে নিয়ে নাটকটি। এ তো নাট্যকারের ইচ্ছাকৃত।

নাট্যকারকে একদিকে আক্রমণকারী মোগল শক্তির বিরুদ্ধে মেবারের রাজাকে দীছে করাতে হয়েছিল, অপরদিকে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের জন্য হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের বাণীও প্রচার করতে হয়েছিল। এই দোটানায় পড়ে নাট্যকার অনেক সময়েই ইতিহাস থেকে চাতে হতে বাধ্য হয়েছিলেন। মেবারের গৌরবের দিন পর্যন্ত বিশেষ ইতিহাস জাতির প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু মেবারের পতন হবার পর হিন্দু শক্তি অধোগামী হয় এবং তারই ফলে হিন্দু-মুসলমানে মিলন-কল্পনা সহজতর হয়। এই লক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দিজেন্দ্রলাল ইতিহাস- চ্যুত হলেন। মেবারপতন নাটকের প্রথম গানটি সত্যবতী ও চারণীদের। এতে মেবারের শৌর্য-বীর্যের গান শোনা গেছেপ্রতাপ-বীরের জয়ধ্বনি শোনা গেছে। এখনো তো মেবারের পতন হয়নি বোধ হয় তাই এটা সম্ভব হয়েছিল।

নাট্যকার রাণা অমর সিংহের এক কন্যাকে নাটকে উপস্থিত করেছেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গলের মত। তিনি শত্রু-মিত্রের সেবায় ব্যস্তহিন্দু-মুসলমানকে টেনে নিয়েছেন একান্ত নিকটে। এই চরিত্রটি কাল্পনিক। সমকালীন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নাট্যকারের এই চরিত্র সৃষ্টি।

সাজাহানকেও এখানে অত্যন্ত উদাররূপে দেখানো হয়েছে! তিনি যুদ্ধ জয়ের পর যেন মেবারপক্ষীয় হয়ে উঠেছেন। সত্যবতী ও চারণীদলের বেদনার সঙ্গীতে সাজাহান যোগ দিলেন, তাঁর আদেশে যোগ দিল হেদায়েৎ আলি, যোগ দিল মোগল সৈন্যগণ। ইতিহাসকে ডিঙিয়ে নাট্যকার হিন্দু-মুসলমানে মিলনের ব্যবস্থা করলেন।

মানসীর মুখ দিয়ে নাট্যকার বিশ্বপ্রেমের বাণী ছড়ালেন। দেশ গেলেও দুঃখ নেই- সকলকে মানুষ হতে হবে। মানুষ হওয়ার উপায়টাও বাতলেছেন নাট্যকার কল্পিত চরিত্র মানসীর মুখ দিয়েই : বিশ্বপ্রেমিক হতে হয় শত্রু মিত্রজ্ঞান ভুলে গিয়ে, বিদ্বেষ বর্জন করে, নিজের কালিমা, দেশের কালিমা বিশ্বপ্রেমে ধৌত করে দিয়ে।দেশের সমকালীন প্রয়োজনে ইতিহাসকে বর্জন করলেন নাট্যকার। ইতিহাস অপেক্ষা তাই এসব নাটকে, বিশেষ করে মেবার-পতন’-এর উদ্দেশ্যই বড় হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের তথ্যনিষ্ঠ না হয়ে নাট্যকার মানব-জীবনের সত্যনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।


বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন